দুনিয়া বিবর্জিত শিক্ষা কি কুশিক্ষা? ভন্ড,কপটের শিক্ষা? আল্লাহর নির্দেশনা বিবর্জিত এবং ভিক্ষাবৃত্তি !?
আসলেও কি তাই !?
কথাটি ঠান্ডা মথায় ভাবার মতো। এর কী মারাত্মক মর্ম দাড়ায় তা বুঝা উচিৎ!
এর দ্বারা যদি দুনিয়াবী শিক্ষা মুক্ত শিক্ষা উদ্দেশ্য হয় তাহলে প্রশ্ন হলো, সকল নবী ও সাহাবী কি ঐশী ইলমের পাশাপাশি দুনিয়াবী শিক্ষা অর্জন করেছিলেন? কুরআন ও হাদিস খুঁজলে কয়েকজন ছাড়া তেমন কাউকে পাওয়া যাবে না । ইলম সংক্রান্ত কুরআনের প্রায় সকল আয়াত আমি পড়েছি। প্রত্যেকটি আয়াতের ব্যাখ্যায় ইলম বলতে শরীয়তের ইলম উদ্দেশ্য নেওয়া হয়েছে। কোনো মুফাসসির শরীয়তের ইলমের সাথে দুনিয়াবী ইলমের ব্যাখ্যা করেননি এবং আল্লাহ তাআলাও কোথাও ঐশী ইলমের পাশাপাশি দুনিয়াবী শিক্ষার কথা উল্লেখ করেননি। এমনকি দুনিয়াবি ইলম অর্জন না করার কারণে কোরআন- হাদিসে কোথাও নিন্দা করা হয়নি।
একটি হাদিসের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
নবী (ﷺ) খেজুর গাছকে পরাগায়িতকারী কিছু লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। তিনি বললেন, যদি এটা না করো তাহলে ভালো হবে। লোকেরা তা করলো না। এতে সে বছর ’চিটা’ খেজুর উৎপন্ন হলো। পরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের কাছ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের খেজুর গাছের কী হলো? লোকেরা বললো, আপনি এমন এমন বলেছিলেন (তা করায় এরূপ হয়েছে)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ তোমাদের পার্থিব বিষয়ে তোমরাই অধিক অবগত। (মুসলিম ৫৯১৬) এখানে তিনি নিজেকে পার্থিব জ্ঞানের পারদর্শী দাবি করেন নি।
তাহলে কী করে দুনিয়াবী শিক্ষা মুক্ত ঐশী ইলম কুশিক্ষা হতে পারে?
আর যদি দুনিয়া বিবর্জিত শিক্ষা দ্বারা দুনিয়াবী উপার্জনমুক্ত শিক্ষা উদ্দেশ্য হয় তাহলে আমি বলব, ঐশী ইলম নিয়ে ব্যস্ত থাকা একটি বড় দায়িত্ব আর উপার্জন করা আরেকটি ছোট দায়িত্ব । কেউ যদি ঐশী শিক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে জীবিকা উপার্জনের দায়িত্ব পালন করতে না পারে তাহলে তার অপর দায়িত্বটিকে কেন দোষারোপ করা হবে? এ কারণে ঐশী জ্ঞান নিয়ে ব্যাস্ততাকে কি কুশিক্ষা বলা বৈধ হতে পারে?যার অর্থ দাড়ায় ঐশী জ্ঞানকে কুশিক্ষা সাব্যস্ত করা। কেউ যদি জীবিকা নির্বাহ না করে ঐশী জ্ঞান অর্জন করতে গিয়ে পার্থিব কষ্ট করে থাকে এতে তো শরীয়তে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। এমন নজির নবী ও সাহাবিদের মাঝে বহু রয়েছে।
তাহলে কী করে দুনিয়াবি উপার্জন মুক্ত শিক্ষা কুশিক্ষা হতে পারে?
যদি দুনিয়াবী উপার্জনমুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা নিন্দিত হয়ে থাকে তাহলে প্রশ্ন হলো জেনারেল শিক্ষাব্যবস্থা কেন নিন্দিত হবে না? সেখানেওতো বিশাল একটি অংশ দুনিয়াবি অন্য উপার্জন মুক্ত শুধুমাত্র পঠনপাঠন নির্ভর। শুধু পার্থক্য এতটুকু। তারা সেকু+লার বা ধর্মহীন শিক্ষা ব্যবস্থাকে গ্রহণ করে এবং সে+কুলার রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে পূঁজা করে আরাম-আয়েশের জীবন যাপন করছে আর অন্যরা সেকুলা+র শিক্ষা ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে ঐশী শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে কষ্টের জীবন বরণ করে নিয়েছে।
দুনিয়া বিবর্জিত শিক্ষা যদি কুশিক্ষা হয়ে থাকে তাহলে ফরজে কিফায়া ইলমের ধারণকারী কারা হবে এবং এই আয়াতের সম্বোধিত দল কারা হবে? " মু’মিনদের সকলের একসঙ্গে অভিযানে বের হওয়া সংগত নয়, এদের প্রত্যেক দলের এক অংশ এজন্য বাহির হয় না কেন, যাতে তারা দ্বীন সম্বন্ধে গভীর জ্ঞানানুশীলন করতে পারে আর তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে, যখন তারা তাদের নিকট ফিরে আসবে যাতে তারা সতর্ক হয়। "(সূরা তাওবা ১২২)
আমাদের দেশের বর্তমান রাষ্ট্রকাঠামোর প্রেক্ষাপটে দুনিয়াবি অর্জনের সাথে সাথে ফরজে কিফায়া ইলমের ধারণ করা এবং এই আয়াতের বাস্তবায়ন করা কতটুকু সম্ভব? কোনো নজীর দেখানো যাবে?
তবে হ্যাঁ, দ্বীনি শিক্ষার পাশাপাশি শরীয়ার সাথে সাংঘর্ষিক নয় এমন দুনিয়াবী শিক্ষা অর্জন করা বৈধ এবং অনেক জায়গায় উৎসাহিতও করা হয়েছে। কিন্তু তা ফরজ করা হয়নি। বরং শুধু দ্বীনি শিক্ষাকেই ফরজে আইন বলা হয়েছে। (দেখতে পারেন ইবনে মাজার ১২৪ নং হাদিসের ব্যাখ্যা)
মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে ভিক্ষাবৃত্তি আখ্যায়িত করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো! খেলাফত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে আবু হুরায়রা, ইবনে মাসউদ, আবূ সাইদ খুদরি ও সালমান ফারসী রা. সহ বড় বড় ইলমী সাহাবী যাদের উপর কুরআন হাদিসের ইলম নির্ভর সেই আসহাবুস সুফ্ফাদের ইলম অর্জনের ইতিহাস কী?
সুফফাবাসীর ব্যয়ভার ব্যক্তিগত ও সামাজিক উদ্যোগে পূরণ করা হতো। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘আমিও আসহাবে সুফফার একজন ছিলাম। যখন সন্ধ্যা হতো, আমরা সবাই নবী (সা.)-এর কাছে চলে যেতাম। তিনি একজন-দুজন করে ধনী সাহাবিদের কাছে সোপর্দ করতেন। যারা অবশিষ্ট থাকত তাদের তিনি নিজের সঙ্গে খাবারে শরিক করতেন। খাওয়ার পর আমরা রাতে মসজিদে ঘুমাতাম।’ এ ছাড়া মসজিদে নববীর দুটি খুঁটির মধ্যে একটি রশি বাঁধা থাকত। আনসার সাহাবিরা বাগান থেকে থোকা থোকা ফল এনে আসহাবে সুফফার জন্য তাতে ঝুলিয়ে রাখতেন। আসহাবে সুফফা তা লাঠি দ্বারা নামিয়ে খেতেন। মুয়াজ বিন জাবালের (রা.) ব্যবস্থাপনা ও দেখাশোনা করতেন। (সিরাতে মোস্তফা : ১/৪৪৮)
আল্লাহ বলেন, 'তারাই বলে, আল্লাহর রাসূলের সাহচর্যে যারা আছে তাদের জন্যে ব্যয় করো না। পরিণামে তারা আপনা-আপনি (তার সাহচর্য থেকে) সরে যাবে। অথচ ভূ ও নভোমন্ডলের ধন-ভান্ডার আল্লাহরই কিন্তু মুনাফিকরা তা বোঝে না। ( সূরা মুনাফিকুন ৭)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, লোকে বলে, আবু হুরায়রা (রাযি.) বেশী হাদীস বর্ণনা করে।(প্রকৃত ঘটনা এই যে,) আমার মুহাজির ভাইয়েরা বাজারে কেনাবেচায় এবং আমার আনসার ভাইয়েরা জমি-জমার কাজে ব্যস্ত থাকত। আর আবু হুরায়রা (রা.) (খেয়ে না খেয়ে) তুষ্ট থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সঙ্গে লেগে থাকত। তাই তারা যখন উপস্থিত থাকত না, তখন সে উপস্থিত থাকত এবং তারা যা মুখস্থ করত না সে তা মুখস্থ রাখত। (বোখারি ১১৮)
এবিষয়ে বহু দলিল পেশ করা যাবে।
প্রশ্ন হলো এসব আয়াত ও হাদিসে বর্ণিত ইতিহাসকেও কি ভিক্ষাবৃত্তি বলা হবে? যদি সেটা ভিক্ষাবৃত্তি না হয় তাহলে এটা কেন ভিক্ষাবৃত্তি হবে? আর যদি সেটা ভিক্ষাবৃত্তি হয়ে থাকে তাহলে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই।
সে+কুলার শাসনের অধীনে ধর্মীয় শিক্ষা কতটুকু নিরাপদ তা আর ব্যাখ্যা করা লাগবে না। বর্তমান মুসলিম শিক্ষাব্যাবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষার বেহাল দশা কে না জানে! আলিয়া শিক্ষাব্যবস্থার মরা লাশের দুর্গন্ধ কার নাকে না পৌঁছায়? কওমিকে টেনে তাদের অধীন করলে ব্যতিক্রম কিছুই আশা করা যায়না।
ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম হিসেবে বংশপরিচয়ের মতো দেওবন্দের ইতিহাসও জেনে রাখা জরুরি। ব্রিটিশদের আগ্রাসনে যখন জানাযা পড়ানোর মতো মুসলিম খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে সেই কঠিন সময়ে জীবনবাজি রেখে দেওবন্দিরাই মুসলিম অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। আজ অবধি চলমান তাদের এই অবদান অস্বীকার করলে অকৃতজ্ঞ নাফরমান ছাড়া আর কিছুই বলার নেই।
দেওবন্দী এই শিক্ষাব্যবস্থা মুসলিমদের স্থায়ী সমাধান নয়। বরং এটা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের অস্তিত্ব, আত্মপরিচয় ও স্বকীয়তা টিকিয়ে রাখার বিকল্প এক সংগ্রাম। যতদিন এই ব্রিটিশ দাসত্ব বিলুপ্ত না হবে ততদিন অস্তিত্বের এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।
তাদেরও তো মনে চাই আপনাদের মতো আরাম আয়েশেের পথে চলতে কিন্তু আদর্শের কাছে মাথানত করে সে পথকে তারা লাথি মারতে বাধ্য হয়েছে। তবে মুসলিমদের দুর্ভাগ্য যে তারা প্রকৃত জ্ঞানীদের অবহেলা করে কুরআনের ভাষায় 'গাফেল জ্ঞানীদের' মূল্যায় করে যাচ্ছে!
আমার আপনার পদস্খলন হতে পারে তাই বলে শরীয়তের বিধান বিকৃত হতে পারেনা।
0 Comments